Tuesday, December 23, 2008

অনুসরণ

মাসুদ রানা
সুকুবা, জাপান
২৩ ডিসেম্বর, ২০০৮


অনুসরণ

যখন কোন মা তার ছেলেকে পাড়ার অপর এক ভাল ছাত্রকে দেখিয়ে তার নিজের ছেলেকে তার মত হতে বলে তখন মা আসলে ছেলেকে কি বলতে চায়? বলতে চায় যে, ঐ ছেলের পড়াশোনার জন্য যে চেষ্টা করে সেরকম করতে । মা কিন্তু কখনও বলতে চায় না, ঐ ভাল ছাত্র কিভাবে হাঁটে, কিরকম পোষাক পরে এসব জিনিস মানার কথা । কোন ফিজিসিষ্ট যখন আইনষ্টাইনকে অনুসরণ করে, তখন সে আইনষ্টাইন এর থিয়োরী, আইনষ্টাইন এর বিশ্বাস মানার চেষ্টা করে, আইনষ্টাইনের মত গবেষণা করার চেষ্টা করে, আইনষ্টাইনের মত পরিশ্রম করার চেষ্টা করে । সেই ফিজিসিষ্ট কিন্তু আইনষ্টাইনের মত ঝাকড়া চুল রাখে না, আইনষ্টাইনের মত কাপড়-চোপরের প্রতি অবহেলা করে না।



রাসুল মুহাম্মদ কে আল্লাহ্‌ কোরানে বেষ্ট উদাহরণ হিসেবে সার্টিফাইড করেছেন । সুতরাং, আমরা তাকে অনুসরণ করব । আমরা বলতে আমি মুসলমানদের কথা শুধু বুঝাচ্ছি না, যে কোন ধর্মের মানুষ তাকে অনুসরণ করার অধিকার রাখে । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা সবসময় সুন্নত জ্বরে ভুগে থাকি । উপরে ভাল ছাত্র আর আইনষ্টাইনের যে উদাহরণ দিলাম তাতে এবং আমাদের অন্তসারশূণ্য মুসলমান সমাজের কথা জানে এমন লোক ইতিমধ্যে বুঝে গেছে আমি আসলে কি বলতে চাচ্ছি । তারপরেও কিছু জিনিস আলোচনা করব ।


আমরা একটা জিনিস বোধ হয় ভুল করি । রাসুলুল্লাহ্‌ রাসুল হয়েছিলেন নিজের যোগ্যতায় । আমি ব্যখ্যার সুবিধার জন্য ধরে নিই, যে ইসলামে নামায, রোযা আর হজ্জ্ব এই তিনটা জিনিস নেই । নামায, রোযা আর হজ্জ্ব দেখে তো রাসুলুল্লাহ্‌র আমলে কেউ মুসলমান হয়নি, তাই না ? আপাতত মনে করি নামায, রোযা আর হজ্জ্ব নেই ইসলামে ।


এবার কোন মুসলমানকে কোন এক অমুসলিম বলল যে, হুম্‌ম্‌, তুমি তো মুসলমান, এবং তোমার কোরান মতেই মুহাম্মদকে তোমাদের অনুসরণ করা উচিৎ; কি কি কর তুমি ? কি উত্তর দিবে সে ? বিশ্বাস করুন, রাসুলুল্লাহ্‌র পোষাক, টুপি আর নামায, রোযা, হজ্জ্ব বাদ দিলে, উত্তর নাই বুকে হাত দিয়ে কয়জন এর উত্তর দিতে পারবে ? নামায করলেই সব হয়, এমন কথা অন্তত বলবেন না ; নিশ্চয়ই, ক্লাশ ফাইভের বাচ্চা ছেলেও হাসবে ঐসব মূর্খের মত কথা শুনলে ।


রাসুলুল্লাহ্‌ কখনও মিথ্যা কথা বলেননি, আমরা পারি তাকে অনুসরণ করতে ? উনি ক্রোধের বশবর্তী ছিলেন না, ক্রোধ তো আমাদেরকে খেয়ে ফেলছে । উনি পরিশ্রমী ছিলেন, কোন কাজকে ঘৃণা করতেন না, উনি অহংকারী ছিলেন না । একটা উদাহরণ দিই, একদিন ঘরে খাবার ছিল না বলে, উনি এক ইহুদীর কূপের পানি তুলতে গিয়েছিলেন । উনি ভাবেন নাই উনার বংশ গৌরবের কথা, উনি পানি তোলাকে ছোট কাজ মনে করেন নি । এবং ঐ ইহুদী লোকটি তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করেছিল, উনি ক্রোধের বশবর্তী হন নি ।


রাসুলুল্লাহ্‌ পরনিন্দা করতেন না, মানুষের কথা মানুষের কাছে গিয়ে লাগাতেন না । ঘুষ, সুদ খেতেন না । স্ত্রীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন না । চুরি করতেন না । মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন না । হীন এবং ছোট মনের ছিলেন না উনি । কথা দিয়ে কথা রাখতেন, ৫টা বলে ৮টায় অনুষ্ঠান শুরু করার মত লোক উনি ছিলেন বলে মনে হয় না । উনি হতাশাবাদী ছিলেন না, উনি কখনও বলেন নি, এই দেশকে দিয়ে কি হবে ?


উনি জ্ঞানী ছিলেন, হয়তো বই পড়েননি, কিন্তু তাই বলে জ্ঞান অর্জন করেননি তা নয় । অবশ্যি উনি প্রচুর ভাবতেন, তা হলে কেন উনি প্রতি বছর গুহায় যেতেন শুধু ভাবার জন্য । আর আমরা ? হায় আল্লাহ্‌, মাথার ব্যবহার কিছুই করি না । আল্লাহ্‌কে অপমান করার এর চেয়ে খারাপ উপায় আর কি থাকতে পারে ?


আমাকে বলুন, কি উত্তর আমি দিব; যদি আমাকে কোন অমুসলমান জিজ্ঞেস করে আমি রাসুলুল্লাহ্‌কে অনুসরণ করি কিনা ? কী, দিতে পারব উত্তর ? বলতে পারব, আমরা বাংলাদেশীরা ৮৫% মানুষ রাসুলুল্লাহ্‌কে অনুসরণ করি । লজ্জা করে যখন, বইয়ে পড়ি বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বড় মুসলিম দেশ । বাংলাদেশের ৮৫% মানুষ মুসলমান, হায়, এর চেয়ে বড় রসিকতা আর কি হতে পারে ? কোন এক ভিন গ্রহ থেকে যদি কোন প্রাণী পৃথিবীতে আসে, এবং তাদের যদি ইসলাম এবং এর বেষ্ট ঊদাহরণ রাসুলুল্লাহ্‌ সম্পর্কে জানিয়ে বলা হয়, খুঁজে বের কর তো এদের এদের ঘনত্ব কোথায় বেশী, আমার মনে হয় না বাংলাদেশ হবে সেই জায়গা; বরঞ্চ জাপান বেশ এগিয়ে থাকবে বলে মনে হয় । হ্যাঁ, জাপান এগিয়ে থাকবে । লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌ বললে আর মুসলিম নাম না থাকলে মুসলমান হওয়া যায় না, এই ধারণা যদি পোষণ করেন তাহলে আর কি বলব?


হায়রে মুর্খ মুসলমানেরা নকল করা আর অনুসরণ করা তো এক জিনিস না । আমাদের অবস্থা এখন এমন আমরা একজনের রিপোর্ট পুরোপুরি নকল করে লজ্জা তো পাই ই না, বরঞ্চ বুক ফুলিয়ে সেই কথা প্রচার করি । নামায রোযার মাধ্যমে আমরা রাসুলুল্লাহ্‌কে নকল করি মাত্র, উনাকে অনুসরণ করি না । কাউকে যদি জিজ্ঞেস করি, তোমার বাবা ধার্মিক, তাই না ? উত্তরে সে বলবে, বাবা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন। খুব সম্ভব তার বাবা আসলেই ধার্মিক, কিন্তু পয়েন্ট তা না, পয়েন্ট হচ্ছে শুধু নামায রোযাকেই ধার্মিকতার মানদন্ড হিসেবে ধরে নিই । কী অপমান করি আমরা রাসুলুল্লাহ্‌কে !


হ্যাঁ, রাসুলুল্লাহ্‌কে অনুসরণ করাকেই বলে সুন্নত পালন করা । মরিচীকার মত সওয়াবের লোভ আমাদের জীবনে ভাইরাসের মত প্রবেশ করেছে । চার রাকাত সুন্নত নামায, তা নিয়ে পরে বলছি; কয়েকটা ঊদাহরণ দিব, আমরা নিরেট গবেটের মত কি সুন্নত পালন করি এবং মনে করি আমাদের সওয়াবের পাল্লা দিন দিন ভারী হচ্ছে ।


রোযার দিন ইফতারের সময় খেজুর খেয়ে রোযা ভাঙ্গাকে আমরা সুন্নত এবং সওয়াবের কাজ মনে করি । কারন, রাসুলুল্লাহ্‌ তা করতেন । ওরে মূর্খ, রাসুলুল্লাহ্‌র খাবারের মেন্যুর একটা উপাদান ছিল খেজুর, উনি খেজুর খাবেন না তো কি খাবেন ? আল্লাহ্‌ রাসুলকে পাঠিয়েছেন আমাদের মাঝে জ্ঞান বিতরন করার জন্য, আমার কথা না, কোরানের কথা । কেউ যদি বের করতে পারেন, হ্যাঁ, সারাদিন না খেয়ে থেকে, মিষ্টি জিনিস খাওয়া শরীরের জন্য ভাল, তাহলেও, মিষ্টি জিনিস অনেক আছে, খেজুর কেন? এরকম নকল করার অর্থ কি ? কেন উনি যে পোষাক পরতেন সেই পোষাক পড়তে হবে ? উনি রাসুল ছিলেন, একইসাথে সৌদি ছিলেন, উনি ওইরকম পোষাক পড়বেন, তাই বলে গরমের দেশে হোক, ঠান্ডার দেশে হোক ঐরকম নকল করতে হবে? এর মাঝে শিক্ষার কি আছে ?


আমরা কি নকল করা ছেড়ে উনাকে অনুসরণ করতে পারি না ।


সুন্নত নামায

সুন্নত মানে কি ? পথ । হ্যাঁ রাসুলুল্লাহ্‌ যে পথে চলেছেন তাই ই সুন্নত । সেই পথে চলাটা সুন্নত । উনার উঠা-বসা টাইপের জিনিস নকল করার নাম সুন্নত না । কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় জোহরের নামায, উত্তর ৪ রাকাত সুন্নত, ৪ রাকাত ফরয, ২ রাকাত সুন্নত । কেন ঐ সুন্নত নামায কেন? কারণ রাসুলুল্লাহ্‌যা সবসময় করতেন তাই সুন্নতে মুয়াক্কাদা, মানে পালন না করলে গুনাহ্‌ হবে । আমি জানি না, এই ধারণা কার মাথা থেকে প্রথম এসেছে । রাসুলুল্লাহ্‌ সবসময় যা করতেন, তাই যদি সুন্নত হবে তাহলে ঐ একই কথা বলতে হয়, উনি সারাজীবন ধরে নিজের চরিত্র গঠন করেছেন । ঐটাই কি সুন্নত না ? আমি মোটেও জ্ঞানী নই, শুধু মাঝে মাঝে একটু চিন্তা করতে ভালবাসি । রাসুলুল্লাহ্‌ সবসময় যা করতেন, তাই যদি সুন্নতে মুয়াক্কাদা হয়, তাহলে কেন তাহাজ্জুদ নামায সুন্নতে মুয়াক্কাদা না? ঐটা করা কঠিন বলে ? আল্লাহ্‌ নিজে তাহাজ্জুদ নামাযকে অনেক পছন্দ করেন । কিন্তু ঐটা নফল? কখনও মন থেকে ইচ্ছা হয় আমাদের যে, ফরয এর চেয়ে বেশী নামায পড়ি । নামায কি? সহজ কথায় আল্লাহ্‌র সাথে দেখা করতে যাওয়া, আল্লাহ্‌র সাথে কথা বলা । কখনও মনে হয়, আমার আল্লাহ্‌র সাথে আরো বেশী কথা বলা দরকার? এবং তখন ফরযের বাইরেও নামায পড়ার কথা ? আমরা তো বেশীরভাগ সময় পাপের ভয়ে সুন্নত পড়ি । হায় কি অজ্ঞতা ! এইসব নিয়ম-কানুন আমাদের কাছে হাতে পায়ে শিকলের মত হয়ে গিয়েছে । আমরা হয়ে গিয়েছি শপিং সেন্টারের পুতুলের মত । শরীর আছে, পোষাক আছে, আত্মা নাই । আমাদের নামায রোযা ঐ পুতুলের মতই ।


রোযা

যারা এই লেখা পড়ছেন, তারা নিজের কাছেই প্রশ্ন করবেন প্লীজ । আমরা কী রোযা রাখি ? আবারো সেই একই কথা । কোন এলিয়েনকে রোযার মাসে বাংলাদেশে এনে যদি বলা হয়, দেখো,এই জাতিটা সংযম পালন করছে, মানে রোযা রাখছে । আমার পুরো বিশ্বাস সেই এলিয়েন খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠবে ।


আমাকে হতাশাবাদী মনে করবেন না । আমি তা নই । আমাকেও এও বলবেন না, এইসব তো পুরাতন কথা, সবাই জানি ।E-mc2আমরা সবাই জানি । তাই বলে কি তার অর্থ আমরা সবাই বুঝি ? একই জিনিস শুধু ইনফরমেশনটা জানাকে জানা বলে আমার মনে হয় না ।


এই লেখার সাথে সম্পর্ক আছে বলেই আমি ডা, লুৎফর রহমানের প্রবন্ধ সমগ্র থেকে কিছু কোটেশন দিচ্ছে । আশা করি, চিন্তার খোরাক পাবেন । মহৎ জীবন এ উনি বলেছেন,

তুমি যে জাতিই হও না, ভিন্ন জাতির প্রতি তোমাকে অভদ্র হতে হবে কেন? তোমার মনুষ্যত্ব, তোমার জ্ঞান দেখেই মানুষ তোমার ধর্ম ও সমাজকে সম্মানের চোখে দেখবে ।


হযরত মোহাম্মদ(স) যে এত মানুষকে মুসলমান করেছিলেন, সে কীসের বলে ? তাঁর মনুষ্যত্ব, তাঁর আশ্চর্য ভদ্রতা মানুষের মনকে মুগ্ধ করে দিত । বস্তুত হযরত মোহাম্মদের(স) জীবনে তাঁর ভদ্রতা ছিল আশ্চর্য জিনিস । তাঁর স্নেহ, তাঁর সহনগুণ, তাঁর স্বভাবের অনন্ত মাধুরী মানুষকে পাগল করে দিত ।


উচ্চ জীবন এ ডা। লুৎফর রহমান বলেছেন,

হযরত মুহম্মদ(স) পতিত, পাপান্ধ, অনুভুতিহীন মানুষের জীবন দেখে অশ্রু বিসর্জন করেছিলেন । তিনি ভেবেছিলেন সোনার মানব জীবন কেন এত পাপে কলঙ্কিত হবে ? মানুষের পাপ তাঁর কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল ।


তিনি তাঁর শিষ্যমন্ডলীকে ভালবাসেন, শেষ দিনে তিনি মানব নাম উচ্চারণ করবেন এই কথা বলেই আমরা যদি তৃপ্তি লাভ করি, তা হলে আমরা অপদার্থ । তিনি আমাদের পাপ ও অন্ধতা দেখে কেঁদে দিয়েছিলেন সে কথা আমাদের স্মরণ নেই, আমরা কেবল তাঁর দয়ার মহিমা প্রচার করি । কী বিড়ম্বনা, বিবেক ও চিন্তাহীন জাতির পতন কি আশ্চর্যভাবে সংঘটিত হয় ।


সহজ কথা, আল্লাহ্‌র রিকমেন্ডেশন অনুসরণ করলে অর্থনৈতিক, সামাজিক, আত্মিক, জ্ঞান-বৈজ্ঞানিক সব দিক দিয়ে মুসলমানদের উপরে থাকার কথা । যেকোন জিনিসের আউটপুট থেকেই বোঝা যায়, তার ইনপুট আর ব্লাক বক্স কেমন । আমাদের নিজেদের আউটপুট দেখে কি আমাদের আরেকবার শুরু থেকে চিন্তা করা উচিৎ না, আমরা কি করছি ?


আমার যেকোন ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ।

No comments:

Post a Comment