Wednesday, April 30, 2008

২০টি বানরের গল্প [দ্বিতীয় অংশ]

মাসুদ রানা
৩০ এপ্রিল, ২০০৮ সুকুবা, জাপান

২০টি বানরের গল্প [দ্বিতীয় অংশ]

সূরা বাকারায় আদম(আঃ) এবং শয়তানের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে । আমরা সবাই সেই কাহিনী জানি যে, আল্লাহ্ আদম(আঃ) কে সৃষ্টির পর হাওয়া(আঃ) কে সৃষ্টি করলেন । তারপর, ফেরেশতাদের বললেন আদম(আঃ) কে সিজদা করতে । সবাই করল, কিন্তু ইবলিশ করল না । সে শয়তান হয়ে গেল । আমরা জিনিসটাকে গল্প ছাড়া আর কিছু মনে করি না । কিন্তু আসলেও কি তাই ?

প্রথমে সিজদা জিনিসটা ব্যাখ্যা করা যাক । সিজদাটা আসলে কি ? উত্তর সহজ, আমরা নামাযে যে সিজদা দিই । তা ঠিক, আমরা নামাযে সিজদা দিই । সিজদা জিনিসটা হচ্ছে এরকম, যে আমাদের উপর আল্লাহ্র এত দয়া, আল্লাহ্ আমাদেরকে এত জিনিস দিয়েছেন, আল্লাহ্ এত বড় যে আমরা তাকে সিজদা দিই । কিন্তু কেন দিই ? বলে রাখি, শুধু উঠ-বস করলাম, সেটাই সিজদা হয় না । আমি সিজদা জিনিসটাকে এভাবে দেখি, ধরলাম আমি নিজে পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত একজন বিজ্ঞানী । কাজেই, বর্তমান বিশ্বের পদার্থবিদ্যায় আমার জ্ঞান অনেক । আমি যখন নামাযে দাঁড়ালাম, আল্লাহ্ কিন্তু আমার দিকে মনোযোগ দিলেন । আমি আল্লাহ্র সম্মুখে দাঁড়িয়ে । আমি তখন ভাবা শুরু করলাম, আমি নোবেল প্রাইজ পেয়েছি, কিন্তু আল্লাহ্ তিনি এই মাহাবিশ্ব তৈরী করেছেন । আমি পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে জানি, কতটা পারফেক্ট অবস্থায় আছে আমাদের সৌরজগত্ । নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত আমি সৌরজগতের সবকিছু ঠিকমত ব্যাখ্যা পর্যন্ত করতে পারি না, আর আল্লাহ্ এগুলো সব বানিয়েছেন । আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আর তিনি আমার দিকে মনোযোগ দিয়ে আছেন । তার সামনে আমি কত ছোট যে এভাবেই মাথা নত হয়ে আসে । তখন আমরা রুকুতে চলে যাই । তারপর দেখি যে না, শুধু ঐটুকু করলেই হচ্ছে না, আমরা একদম সিজদা দিয়ে দিই । সিজদা হচ্ছে বিনয়ের সর্বোচ্চ ধাপ, আমরা এতে আমাদের মাথা মাটিতে ঠেকিয়ে ফেলি । সিজদা প্রথমে আসবে মন থেকে । এবং তখন শরীর এমনিতেই ঝুঁকে যাবে । এইটাই সিজদা ।

এবার আসা যাক কোরানে আদম(আঃ) সম্পর্কে কি বর্ণিত গল্প বিষয়ে । আমরা এটটাই অন্ধ যে, কোরানের আয়াতগুলোকে কত সহজভাবে নিয়ে নিই; যেখানে আল্লাহ্ কোরানেই বলেছেন যে তার আয়াতকে আমরা যেন হালকাভাবে না নিই । আদম(আঃ) কে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ্ আদম(আঃ) কে কিছু জিনিসের নাম শিখিয়ে দিলেন । তারপর ফেরেশতাদের সেই জিনিসগুলোর নাম বলতে বলা হল । তারা পারল না । তারপর আল্লাহ্ ফেরেশতাদেরকে বললেন আদম(আঃ) কে সিজদা করতে । ফেরেশতারা করল । তারপরে কি হল সেইটাও আমরা সয়াবি জানি । কিন্তু ঐটা আজকের বিষয় না । আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ফেরেশতারা কেন সিজদা করল ঐ মানুষটাকে ? কেউ কেউ বলবেন, আল্লাহ্ আদেশ করেছেন বলে । তা ঠিক । কিন্তু ফেরেশতারা কি কিছু না বুঝেই সিজদা দিয়ে দিবে ? কেন সিজদা করতে হবে না জেনেই তারা সিজদা করে ফেলবে ? আর, আল্লাহ্ও কি কোন কারণ না দেখিয়েই তাদেরকে ঐ মানুষটাকে(আদম(আঃ)কে) সিজদা করতে বলবেন ? আমার অন্ততঃ তা মনে হয় না । ফেরেশতারা আল্লাহ্র আদেশ অবশ্যি পালন করেছে । কিন্তু কেন করতে হবে সেইটা তারা সম্পূর্ণরূপে বুঝে , নিজেরা মন থেকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করে সিজদা করেছিল । আমি আবার প্রশ্ন করলাম, তাহলে কি ছিল সেই জিনিস, যাতে ফেরেশতারা এটটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে, একজন মানুষ(আদম(আঃ)) এর সামনে তাদের মাথা নত হয়ে আসছে ? আসলেই কি সেটা ??

যাদের মনে এখনও সন্দেহ যে ফেরেশতারা কি আসলেই অন্ধভাবে আল্লাহ্র আদেশ পালন করেছিল, তাদের জন্য বলি, ফেরেশতারা কিন্তু আল্লাহ্কে প্রশ্ন করেছিল । তারা কিন্তু আল্লাহ্র সিদ্ধান্তর উপর প্রশ্ন করেছিল । আল্লাহ্ যখন ফেরেশতাদেরকে মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে সংকেত দিলেন, তখন কিন্তু তারা বলে নি, আল্লাহ্ তুমি সিদ্ধান্ত নিয়েছ, তাহলে আমরা আর কি বলব ? বরঞ্চ তারা প্রশ্ন তুলেছিল, কেন এই মানুষকে সৃষ্টি করা দরকার ? কেন এই মানুষ যারা হানাহানি করবে, রক্তপাত করবে, তাদের অযথা সৃষ্টি করার কি দরকার ? কাজেই প্রথমে ফেরেশতারা মেনে নিতে পারছিল না মানুষ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তাকে । আর সেই ফেরেশতারাই কেন এত মুগ্ধ হয়ে গেল যে, তারা মানুষকে সিজদা করে ফেলল ?

ইংগিতরা রয়েছে ঐ জায়গায়, যেখানে ফেরেশতারা কিছু জিনিসের নাম বলতে পারল না, কিন্তু আদম(আঃ) বলে দিলেন । এখন আমি আবার প্রশ্ন করলাম, আল্লাহ্ আদম(আঃ)কে শিখিয়ে দিয়েছেন বলে আদম(আঃ) বলতে পেরেছেন । ফেরেশতাদের শিখিয়ে দিলে নিশ্চয়ই তারাও বলতে পারত । তাহলে এখানে আর শ্রেষ্ঠত্বের কি আছে মানুষের ? কিন্তু ফেরেশতারাও তো মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়েছিল । আমার যা মনে হয়, আল্লাহ্ এখানে মানুষের ইন্টেলেক্ট কে নির্দেশ দিয়েছেন । মানুষের চিন্তা করার অসাধারণ ক্ষমতাকে নির্দেশ করেছেন । মানুষের শেখার অসাধারণ ক্ষমতাকে নির্দেশ করেছে । আর ফেরেশতারা এই চমত্কার জিনিসটাতে এটতাই মুগ্ধ হয়েছিল যে, তারা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়েছিল ।

আমরা যদি একটু ভেবে দেখি, আমরা কোন দিক দিয়ে ফেরেশতাদের চেয়ে সেরা ? শক্তিতে ? পাগল-১০০কেজি ওজনের পাথর তুলতে পারি না । ফেরেশতারা কোন ভূল করে না, আল্লাহ্র আদেশ পুংখানুপুংখভাবে পালন করে । আর সেরা মানুষ, নবী-রাসূলরাও পর্যন্ত ভূল করেছেন(মুহাম্মদ(সাঃ) বাদে), আর অন্যান্যদের কথা না হয় বাদই দিলাম । আমরা খুব দ্রুতগতির প্রাণি ? ছোঃ, ফেরেশতাদের গতির কাছে আমরা কি ? কিন্তু তারপরও মানুষ ফেরেশতাদের চেয়ে সেরা । কেন ? কখনো চিন্তা করেছি ? ঐ যে চিন্তা করি নাই, ঐ চিন্তা করতে পারা, সৃষ্টিশীলতা, ঐ কারণেই মানুষ ফেরেশতাদের চেয়ে সেরা । মানুষ ফেরেশতাদের চেয়ে সেরা হওয়ার আরেকটা কারণ, মানুষ আল্লাহ্র গুণে গুণান্বিত হতে পারে । মানুষ হতে পারে ক্ষমাশীল, মানুষ হতে পারে দয়ালু, মানুষ রাগ করতে পারে, মানুষ নতুন জিনিস সৃষ্টি করতে পারে, মানুষ ধৈর্য ধরতে পারে, মানুষ সহ্য করতে পারে, মানুষ পারে ভালবাসে, মানুষ ত্যাগ স্বীকার করে । চিন্তা করে যদি দেখি, এসবই আল্লহ্র গুণ । মানুষ এভাবেই আল্লাহ্র গুণে গুণান্বিত হতে পারে । আর একারণেই হয়তো, আল্লাহ্ যখন মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে ফেরেশতাদেরকে বলেছেন, তখন কিন্তু আল্লাহ্ বলেছেন যে তিনি দুনিয়াতে তার প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন । চুপ করে বসে একটু ভেবে দেখলাম, প্রতিনিধি মানে কি ? এম্ব্যাসেডর । আমরা মানুষেরা হচ্ছি, দুনিয়াতে আল্লাহ্র এম্ব্যাসেডর । কত বড় একটা পোষ্ট !! এই কারণেই মানুষ, এত ভূল করার পরেও ফেরেশতাদের চেয়ে সেরা । মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার চিন্তা করার ক্ষমতা আর তার মানবিক গুণাবলীতে ।

আর আমরা সেই চিন্তা করি না । মস্তিষ্ক ব্যবহার করি না । হায় !

আবার অনেকে বলে আমল(কাজ) করতে হবে । জ্ঞানের দিকে তাদের আগ্রহ এতই কম ! নিজেরা সামান্য চিন্তা করে না । অন্যের আশায় বসে থাকে । আলেমরা তাদের জন্য চিন্তা করে দিবে, আর তারা তা অন্ধভাবে পালন করবে !! চিন্তা করতে ভয় পায় তারা । যদি ভূল হয়ে যায় । আরে ভাই, মানুষ শব্দটার অর্থই তো যারা ভূল করে । অর্থাৎ যারা ভূল করে তারাই মানুষ । আল্লাহ্ কোরানে মানুষকে বলেছেন, ইন্সান । আর ইন্সান শব্দটা আরবী থেকে বাংলায় অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায়, যারা ভূল করে । আমরা কিন্তু ভূল করতে করতেই শিখি । বাধা পেয়ে পেয়ে আমরা শিখি । একটা হাঁসের বাচ্চা জন্মের পরই সাঁতার কাটতে পারে । মানুষ কিন্তু ভূল করতে করতে শিখে । আর সহীহ্ হাদীস, মানুষ কোন বিষয়ে চিন্তা করে ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ করে যদি ভূল হয় তাহলেও একটা পুরষ্কার, আর যদি সঠিক হয়, তাহলে দুইটা পুরষ্কার । ভূল হলেও পুরষ্কার, কারণ সে অন্ততঃ মস্তিষ্কের ব্যবহার করেছে । কাজেই চিন্তা করতে , কোন কিছু নিয়ে কথা বলতে ভয় কোথায় ? এখন কেউ যদি তথাকথিত হুজুরের সামনে গিয়ে বলে যে, আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, আল্লাহ্র মানুষ সৃষ্টির কি দরকার ছিল ? হুজুর তো তাকে পাপী টাপি, নাস্তিকে-তাস্তিক বলে তাড়িয়ে দিবে । আর সে ভয় পেয়ে যাবে, বলবে আস্তাগ্ফিরুল্লাহ্ । অথচ, ফেরেশতারা এই প্রশ্নটা করেছিল, এবং আল্লাহ্ এর উত্তর কোরানে দিয়েছেন ।

আরেকটু ভেবে দেখি, কোরান হচ্ছে নিদর্শণের (আয়াতের) সমষ্টি । আল্লাহ্ তো আমাদেরকে পুরো বিস্তারিত জানিয়ে দিতে পারতেন । কিন্তু তাহলে তো আমাদের আর মস্তিস্ক ব্যবহার করার চমত্কার সুযোগটা থাকত না !

কোরানে কোন বিষয়ে যদি একাধিকবার বলা থাকে, তাহলে তার গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশী । আমি ধর্মকে সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে ব্যখ্যা করাকে তেমন পছন্দ করি না । আমাদের মাঝে অনেকে আছে, হিসাব করতে বসে যায়, কোন কাজটা করলে কত নেকী । তারপর যোগ বিয়োগ করে । আবার গুন ভাগ করে । হায়রে বোকা ! যাই হোক এইটা আজকের বিষয় না । শুধু একটু তুলনা করার জন্য বলি, ওজু সম্পর্কে কোরানে বলা আছে ২ বার । এতিম সম্পর্কে ১৮ বার । আর সালাত(নামায) সম্পর্কে ৮২ বার । কাজেই চিন্তা করে দেখুন, নামাযটা কতটা দরকারী (নামাযটা আসলে কি যদিও আমরা বুঝি না, যাই হোক) । এই কারণেই হয়তো আমরা নামায নিয়ে এত উঠে পড়ে লেগেছি । ধার্মিকদের মুখে নামায ছাড়া আর কিছু নাই । আবার অনেকে বলে, নামায সব কিছুকে ঠিক করে দিবে ! তাহলে আমার প্রশ্ন, মুসলমানদের আজকে এই অবস্থা কেন ? অবশ্য, সত্যিকারের নামায পড়লে হত হয়তো । কারণ, নামাযে আসলে জীবনের প্রতিটা দিক অন্তর্ভূক্ত । তারপরও হুজুরদের সাথে বলার জন্য গলা মিলিয়ে যদি বলিও নামায, নামায আর নামায । ঠিক আছে, ইল্ম মানে হচ্ছে জ্ঞান । কোরানে ইল্ম এবং মূল শব্দটা বলা হয়েছে কয়বার ? ১০ বার, না । ৫০ বার, না । ৮১ বার, না । ৮৩ বার, না । ১০০ বার! না ! ৮৫৪ বার !!! অনেকে আমাকে ভূল বুঝে, মনে করে আমি নামাযে অনুত্সাহিত করছি । মোটেও না । আমি শুধু বলতে চাই ইসলাম=নামায, রোযা এই ধারণাটা ভূল । কোরানে ৬০০০ এর চেয়ে বেশী আয়াত আছে (সম্ভবত, ৬৬৬৬টি) । নামায, রোযা একটা অংশ মাত্র । আমাদের নামাযে ১০ মিনিট সময় ব্যয় করার জন্য আগ্রহ থাকে, তাহলে কি জ্ঞান অর্জনের জন্য ১০০ মিনিট সময় ব্যয় করা উচিত না ? আমরা যদি নামায নিয়ে ১০ মিনিট কথা বলি, আমাদের কি জ্ঞান নিয়ে ১০০ মিনিট আলোচনা করা উচিত না ? কাউকে যদি আমরা ১০ বার নামায পড়ার জন্য ডাকি । তাকে কি আমার ১০০ বার জ্ঞান অর্জনের জন্য ডাকা উচিত না ? কিন্তু বর্তমানে যেইটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় তা হল, আমরা নামাযের জন্য ডাকি ১০০০ বার, আর জ্ঞানের জন্য ডাকি বা জ্ঞানের কথা বলি ০(শূণ্য) বার ! এইটা কি হওয়া উচিত ?? এইখানেই আমার আপত্তি । আর জ্ঞান জিনিসটা কি তা নিয়ে না হয় পরে আরেকদিন কথা হবে, শুধু যে আমাকে অন্যরা ভূল না বুঝে তার জন্য বলছি, জ্ঞান মানে কিন্তু ইসলাম ইসলাম করলাম, আর আল্লাহহ, আল্লাহ্ করলাম, তাই ই কিন্তু না, মানুষের জীবনের সব কিছুই ইসলাম এর ভিতর অন্তর্ভুক্ত । বায়োলজি, দর্শণ, সমাজ, ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারী, কম্প্যুটার সায়েন্স, সব, সবই ইসলাম এর ভিতরে পড়ে ।

অনেকে বলবে, পন্ডিত হয়েছ ? বেশী বেশী চিন্তা কর । পন্ডিত ! যতই পড়ি, নিজেকে ততই মূর্খ বলে মনে হয় । কোরানে যা সরাসরি নির্দেশ থাকবে, ঐ নিয়ে তো আমি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে পারি না । যেমন, আল্লাহ্ সরাসরি শুকরের মাংস খেতে নিষেধ করেছে, সুদ খেতে নিষেধ করেছেন, ব্যাভিচার করতে নিষেধ করেছেন । আমি তো আর চিন্তা করতে বসব না যে, আসলেই কি ব্যভিচার করা উচিত নাকি একবার দুইবার করা যায়, নাকি বিদেশে করলে দোষ নেই । যেটা আল্লাহ্ সরাসরি না করেছেন, সেইটা না, ব্যস । কিন্তু যে জিনিস অন্য মানুষ ব্যখ্যা করেছে, সে আবু হানিফাই হোক, ড, জাকির নায়েক-ই হোক আর আমাদের পাড়ার হুজুরই হোক চিন্তা না করে অন্ধভাবে, বানরের মত অনুসরণ করব না । আমি মানুষের বানরত্বর স্বভাব থেকে মুক্তি পেতে চাই ।

Friday, April 25, 2008

২০টি বানরের গল্প

মাসুদ রানা
সুকুবা, জাপান
২৪ এপ্রিল, ২০০৮

২০টি বানরের গল্প

একটা খাঁচায় ১০টি বানর রাখা ছিল, আর খাঁচার ছাদে কলা ঝুলানো ছিল । তো, যেই বানরগুলো কলা দেখল একসাথে সবগুলো বানর কলা নেয়ার জন্য লাফ দিল । যেই না লাফ দেয়া অমনই বাইরে থেকে গার্ডরা গরম পানি বানরের গায়ে ঢেলে দিল । গরম পানি ঢালা বন্ধ হলেই বানরগুলো আবার লাফ দিল, আবারো বাইরে থেকে গার্ডরা গরম পানি ঢেলে দিল । এমন করে কয়েকবার চলার পর বানর বুঝে গেল, কলার জন্য লাফ দেয়া যাবে না । কারণ, লাফ দিলেই গরম পানি ।

গরম পানির অভিজ্ঞতা আছে এমন বানরকে অভিজ্ঞ বানর হিসেবে ধরা যাক । এবার খাঁচা থেকে একটা অভিজ্ঞ বানরকে সরিয়ে নিয়ে একটা নতুন বানর ঢুকানো হলো । নতুন বানরটা যেইনা কলা দেখল অমনেই লাফ দিল । কিন্তু এবার আর বাইরের গার্ডরা গরম পানি দিচ্ছে না । তবে অভিজ্ঞ পুরাতন ৯টি বানর নতুনটার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল । আরে করিস কি, করিস কি, কলা নেয়া যাবে না । নতুন বানরটা তো পুরো বোকা হয়ে গেল । আরে এই বানরগুলোর সমস্যা কি ! নিজেরা তো কলা নিচ্ছেই না, বরঞ্চ আমাকেও নিতে দিছে না । কিন্তু এই পর্যন্তই, কেন কলা নেয়া যাবে এই নিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে বাকি ৯টা বানরকে অনুসরণ করে চুপচাপ বসে রইল ।

এইবার করা হলো কি, আরেকটা অভিজ্ঞ পুরাতন বানরকে সরিয়ে তার জায়গায় আরেকটা নতুন বানরকে ঢুকানো হল । এখন, খাঁচায় আছে গরম পানির অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ ৮টি পুরাতন বানর, গরম পানির অভিজ্ঞতা নাই এরকম ১টি পুরাতন বানর এবং ১টি একেবারেই নতুন বানর । এইবারও একই ঘটনা, নতুন বানরটা যেইনা কলা দেখল, অমনি লাফ দিল । আর সাথে সাথে গরম পানির অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ ৮টির সাথে সাথে গরম পানির অভিজ্ঞতা নাই ঐ বানরটিও ওদের সাথে একসাথে নতুন বানরটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল । তো নতুন বানর আর কি করার, আগেরটার মতই কেন কলা নেয়া যাবে না, সেই দিকে না গিয়ে অন্ধভাবে বাকিগুলোকে অনুসরণ করল।

এমন করে একটার পর একটা গরম পানির অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ বানরগুলোকে সরিয়ে নতুন বানর ঢুকানো হয়, আর একই ঘটনা ঘটতে থাকে । এমন করে এখন খাঁচায় যেই বানরগুলো রইলো সেইগুলোর কারোরই গরম পানির অভিজ্ঞতা নাই । তারা জানে না , কেন কলা নেয়ার জন্য লাফ দেয়া যাবে না, কিন্তু তারা কেউ আর কলা নেয়ার চেষ্টা না করে চুপচাপ মন খারাপ করে বসে থাকল ।

গল্পটা এইখানেই শেষ । কিন্তু এই গল্প থেকে দারুণ একটা জিনিস শিখেছি । এই গল্পটা জানার পর, নিজেকে বানরের মতই মনে হয়েছে কয়েকদিন । শুধু আমার নিজেকে না, আমার চারপাশের অনেককেই বানর বলে মনে হয়েছে এবং এখনো হয় । চিন্তা করে দেখলাম, আমরা তো ঠিক একই কাজটা করে থাকি । সবাই করে তাই করি । যেমন, আমাদের সময় লাভ হোক বা না হোক, সবাই প্রাইভেট পড়তে যেত । আমার ভাগ্য ভাল, আমি যাই নাই । এতে কোন ক্ষতিই হয় নাই, বরঞ্চ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম আমি মনিপুর স্কুল থেকে । যাই হোক । আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, বাবা-মা নামায পড়ে । তাই আমরাও পড়ি । কখনো নিজেকে জিজ্ঞেস করি নাই, কেন নামায পড়তে হবে কিংবা নামায জিনিসটাই বা কি ? নিজেকে মুসলমান বলি । মুসলমান বলতে আসলে কি বুঝায়, জানি না । কেন রোযা রাখব ? মসজিদে প্রায় কাপড়বিহীন গরীব মানুষেরা বসে থাকে জুম্মার দিন । তাদেরকে পায়ে ঠেলে ২ রাকাত নামায(যা পড়ি ঐটাকে যদি নামায বলা যায়!) পড়ে মসজিদে ৫টাকা দান করে ফলমূল কিনে নিয়ে বাসায় ফিরে মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে বিশাল ঘুম দেই । কখনোও নিজেকে প্রশ্ন করি না, এইটা কি করছি ?

বিদেশী মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না । বিয়ে করতে গেলে বাসা থেকে সমস্যা ! বিয়ে করা যাবে না । কখনো ভেবে দেখিনা, ইসলাম কি বলছে এই বিষয়ে । অলসতা ২ ধরনের । একটা শারীরিক আরেকটা মানষিক । আমরা যারা একটু ভাল ছাত্র, তারা পড়াশনায় প্রচুর খাটি । এবং খাটাটা অবশ্যি দরকার । এইটাও ইসলামের অন্তভূক্ত । যাই হোক আমরা তাও মাথা খাটাই । কিন্তু আফসোস, মানুষ আজকে চিন্তা করা ছেড়ে দিয়েছে । অনেকে আবার বলে, বেশী চিন্তা করলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে । বটে ! আইনষ্টাইন তার ব্রেনের ১৭% মাত্র ব্যবহার করতে পেরেছিলেন । আর, আমাদের চিন্তায় মাথা খারাপ হবে ?

চিন্তা কেন করি না আমরা ? কেন চ্যালেঞ্জ করি না যে, কেন ৪টা বিয়ে করা যাবে । কেন চ্যালেঞ্জ করি না সুদ কেন দেয়া যাবে না ? আমরা এমনই বোকা, একজন একটা নিয়ম বানায়, আর বানরের মতই সেইটা অন্ধ অনুকরণ করি । হুজুর বলছে সুন্নত না পড়লে গুনাহ্ হবে, কখনো ভাবি না, এই সুন্নত কি জিনিস । আর হুজুররা যদি ভাল মানুষই হবে, তাহলে তাদের এই রকম বাজে হাল কেন ? ঠিক ঐ বানরগুলোর মত । আজকে শেষ একটা ঊদাহরণ দেই, হিল্লা বিয়ে । আধুনিক মানুষেরা এর বিপরীতে । আবার অথাকথিত মৌলবাদীরা এর সপক্ষে চেঁচামেচি করে । একদিকে এরা চেঁচামেচি করে, অন্যদিকে আধুনিক নাট্যকারেরা ভুরিভুরি নাটক লিখে টিভি তে প্রচার করে থাকেন । আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি, যখন সূরা বাকারার ২২০ নম্বর আয়াত থেকে পড়া শুরু করলাম । না মোল্লারা ঠিক, না নাট্যকাররা ঠিক, দুইজনেই ভূল । আমরা কিরকম বানর, যেই জিনিসটার অস্তিত্ব নাই, সেইটা নিয়ে মারামারি করি বিপক্ষে ভুরিভূরি নাটক লিখি, পক্ষে কত ফতোয়া দেই, কিন্তু সুরা বাকারা ২০ মিনিট সময় ব্যয় করে পড়ি না !