Friday, July 25, 2008

কুর্‌আন এবং আধুনিক বিজ্ঞান - সুসঙ্গত নাকি অসঙ্গত [প্রথম অর্ধাংশ]

THE QUR’AN & MODERN SCIENCE

COMPATIABE OR INCOMPATIABLE

Authored by Dr. Zakir Abdul Karim Naik


কুর্‌আন এবং আধুনিক বিজ্ঞান সুসঙ্গত নাকি অসঙ্গত

অনুবাদঃ মাসুদ রানা


ভূমিকা

পৃথিবীতে মানব জন্মের শুরু থেকেই মানুষ সবসময় প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টা করে এসেছে। জীবনের উদ্দেশ্য এবং এই সৃষ্টিজগতে নিজের অবস্থান নিয়ে চিন্তা করেছে। এই সত্যের সন্ধানে, বহু শতাব্দী এবং শত শত সভ্যতা পার করে সুশৃঙ্খলিত জীবন ব্যবস্থা (ধর্ম) মানুষের জীবনকে বহুলাংশে সুগঠিত করেছে এবং ইতিহাস রচনা করেছে। কিছু কিছু জীবন ব্যবস্থা (ধর্ম) আছে, যা সেগুলোর অনুসারীদের মতে তা হচ্ছে লিখিত দলিলেরভিত্তিক; আর কিছু কিছু জীবন ব্যবস্থা (ধর্ম) আছে, যেগুলো মানুষের জ়ীবনের অভিজ্ঞতাভিত্তিক।


মুসলিমদের (আত্নসমর্পণকারী) মতে আল-কোরান (ইসলামী বিশ্বাসের মূল উৎস) হচ্ছে পুরোপুরি ঐশ্বরিক। মুসলিমরা আরও বিশ্বাস করে যে, এটি (কোরান) হচ্ছে সমস্ত মানবজাতি (শুধু মুসলমান নয়) -র জন্য পথ নির্দেশক। যেহেতু কোরানের বার্তা সব যুগের জন্য প্রেরিত , সেই অর্থে কোরানকে সব যুগের জন্যই উপোযোগী হতে হবে। কিন্তু কোরান কি আসলেই এই পরীক্ষায় ঊত্তীর্ণ হতে পারবে?


এই বইয়ে আমি কোরানের ঐশ্বরিক সোর্স সম্পর্কে মুসলিমদের বিশ্বাস, বিশেষ করে প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের আলোকে বিশ্লেষণ করতে চাই।


সভ্যতার এক সময় ছিল, যখন মিরাকল বা যা মিরাকল বলে মনে করা হত, সেসব বিসয় মানুষের যথাযোগ্য কারণ ও যোক্তিকতার উপরে স্থান পেত। অবশ্যই, মিরাকল বলতে বুঝাত, যা দৈনন্দিন জীবনে ঘটে না এমন সব জিনিস কিংবা যার ব্যখ্যা নেই।


কিন্তু, কোন একটা জিনিসকে মিরাকল হিসেবে গ্রহণ করার ব্যপারে আমদেরকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। ১৯৯৩ সালে The Times of India, Mumbai একটি রিপোর্টে প্রকাশ করে যে, বাবা পাইলট নামের এক ঋষি টানা ৩ দিন ট্যাংকের পানির নিচে ডুব দিয়ে ছিলেন। কিন্তু যখন রিপোর্টারেরা তার এই মিরাকলের কৌশল জানার জন্য ট্যাংকের তলা পরীক্ষা করতে চাইলেন, তখন সেই ঋষির আপত্তি উঠলো। সে যুক্তি-তর্ক উত্থাপন করল, কিভাবে কেউ মায়ের গর্ভের ভিতরের জিনিস পরীক্ষা করতে পারে। নিশ্চিত যে, সেই ঋষি কোন কিছু লুকাচ্ছিল! তার ঐ পানিতে ৩ দিন ডুব দিয়ে থাকতে পারার দাবীটা ছিল জনপ্রিয়তা পাবার জন্য একটা ধোঁকা মাত্র। সামান্যতম সুস্থ চিন্তাধারার মানুষ এই ধরনের মিরাকল মেনে নিতে পারবে না। এই ধরনের মিথ্যা মিরাকল যদি আসলেই ঐশ্বরিক হয়ে থাকে, তাহলে, পৃথিবীর সকল বিখ্যাত যাদুকর (যারা অবিশ্বাশ্য সব ম্যাজিক দেখায়) -ই একেকজন ঐশ্বরিক দেবতা।


কোন একটা বই যদি ঐশ্বরিক দাবী করে, তাহলে সেটা আসলে নিজে যে একটা মিরাকল তার দাবীই প্রকাশ করে। এই ধরণের কোন দাবী সেযুগে বিশ্বাসযোগ্য কোন একটা স্টান্ডার্ড বা পরিমাপক দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা যায়। মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে, কোরান হচ্ছে আল্লহ্‌র সর্বশেষ ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ বা আবির্ভূত বার্তা। মুসলিমরা এও বিশ্বাস করে যে, এই কোরান হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ মিরাকল। এবং এই কোরান সমস্ত মানবজাতির পথ প্রদর্শণকারী প্রত্যাদেশ। কোরান সম্পর্কে মুসলিমদের এই বিশ্বাস কতটুকু নির্ভরযোগ্য, তা ভেরিফাই বা প্রতিপাদন করে দেখা যাক।


কোরানের চ্যালেঞ্জ

সাহিত্য এবং পদ্য সব যুগেই মানুষের অনুভূতি প্রকাশের এবং সৃষ্টিশীলতার মাধ্যম হিসেবে গণ্য হয়ে এসেছে। বর্তমান যুগে পৃথিবীর মানুষ যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে গর্ব করে, তেমনি এমন যুগ ছিল, যখন মানুষ সাহিত্য ও পদ্য নিয়ে মানুষ গর্ব করত।


এমনকি অমুসলীমরাও স্বীকার করে যে, আরবী সাহিত্যে কোরান এর অবস্থান হচ্ছে সবার উপরে -- সর্বশ্রেষ্ঠ। কোরান সমস্ত মানব্জাতিকে এরই মত একটা বই লিখে দেখানোর ব্যপারে চ্যালঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।


আমি আমার দাসের প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা তার মত কোন সুরা আনো । আর তোমরা যদি সত্য বল, আল্লাহ্‌ ছাড়া তোমাদের সব সাক্ষীকে ডাকো ।

যদি না কর, আর তা কখনও করতে পারবে না, তবে সেই আগুনকে ভয় করো যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, অবিশ্বাসীদের জন্য যা প্রস্তুত রয়েছে ।

And if ye are in doubt as to what We have revealed fom time to time to Our servant, then produce a Surah like thereunto; and call your witnesses or helpers (if there are any) besides Allah, if your (doubts) are true.

But if ye cannot – and of a surely you cannot – then fear the Fire whose fuel is Men and Stones – which is prepared for those who reject faith.

[আল-কোরান ২; ২৩ - ২৪]


কোরানের চ্যলেঞ্জ হচ্ছে, কোরানে যে সুরা (চ্যাপ্টার) গুলো আছে তার মত একটি সুরা তৈরী করে দেখানো । এই একই চ্যলেঞ্জ কোরানে আরও কয়েকবার বর্ণনা করা হয়েছে । চ্যলেঞ্জটি হলো, কোরানের যেকোন একটি সুরার মত একটি সুরা তৈরী করে দেখানো যা হবে কোরানের সুরাগুলোর মতই সুন্দর, অলঙ্কারপূর্ণ, গভীর অর্থপূর্ণ ।


কবিতার ছন্দে যতই চমত্‌কার হোক না কেন, বর্তমান যুগের কোন বুদ্ধিজ্ঞানসম্পর্ণ মানুষ কোন ধর্মীয় ধারণা গ্রহণ করবে না যদি সেই ধর্মীয় বই বলে যে, পৃথিবী হচ্ছে সমতল । কারণ, আমরা এমন একটা যুগে বাস করছি যেখানে যৌক্তিকতা আর বিজ্ঞানকে প্রাধাণ্য দেয়া হয় । কুরআনের ভাষা যতই চমত্‌কার হোক না কেন, খুব কম লোকই কুরআনকে গ্রহণ করবে যদি কুরআনে যৌক্তিকতা আর বিজ্ঞান না থাকে । কোন বই তখনই ঐশ্বরিক উত্‌স হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে, যখন সেটা নিজস্ব যুক্তিতে শক্তিশালী হবে ।


নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান পঙ্গু, আর বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ । এখন, কুরানকে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক যে, কুরান কি আসলেই আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সমান তালে চলতে পারে কিনা ।


কুরান কোন বিজ্ঞানের বই নয়, বরঞ্চ এটা হচ্ছে নিদর্শনের(আয়াত) বই । কুরানে ছয় হাজারের বেশী নিদর্শন আছে যার মাঝে এক হাজারের বেশী আয়াত পরিশুদ্ধ বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলেছে ।


২ মহাকাশবিদ্যা

মহাবিশ্বের সৃষ্টি বিগ ব্যাংগ

মহাকাশবিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের সৃষ্টিকে বিখ্যাত বিগ ব্যাংগ এর ঘটনা দিয়ে ব্যখ্যা করে থাকেন । বিগ ব্যাংগ এর ঘটনা বহুদিনের ডাটা আর পর্যবেক্ষণ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয়েছে । বিগ ব্যাংগ এর মতে সমস্ত মহাবিশ্বটা শুরুতে ছিল একটিমাত্র ভর(Primary Nebula) । তারপর তার থেকে মহাবিস্ফোরণ এর মাধ্যমে গ্যালাক্সীর সৃষ্টি হয়েছে । তারপর গ্যালাক্সী থেকে তারা, গ্রহ, সূর্য, চাঁদ প্রভৃতি । মহাবিশ্বের উত্‌স ছিল ইউনিক এবং হঠাত্‌ করে এই বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাব্যতা ছিল প্রায় শূণ্য ।


মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে কুরানে নিছের আয়াতটি বর্ণনা করা হয়েছে ।


অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশ ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল ?

Do no the unbelievers see that the heavens and the earth were joined together (as one unit of Creation), before We clove them asunder ?

কুর্‌আন ২১;৩০


কুরানের এই আয়াতটি এবং বিগ ব্যাংগ এর এই অসাধারণ মিল কোনভাবেই অগ্রাহ্য করা যায় না । ১৪০০ বছর আগে এক মরূভূমিতে এরকম শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক সত্য কিভাবে আসতে পারে ?


গ্যালাক্সী সৃষ্টির পূর্বের প্রাথমিক গ্যাসীয় ভর

বিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন যে, মহাবিশ্বের সৃষ্টির পূর্বে মহাবৈশ্বিক পদার্থগুলো প্রাথমিকভাবে গ্যাসীয় অবস্থায় ছিল । সংক্ষেপে বলতে গেলে, গ্যালাক্সী সৃষ্টির পূর্বে বিশাল গ্যাসীয় পদার্থ বিদ্যমান ছিল । প্রাথমিক মহাবৈশ্বিক পদার্থকে ব্যাখ্যা করতে গেলে, গ্যাসের চেয়ে ধোঁয়া শব্দটা বেশী সঠিক । নিচের আয়াতটিতে কুরান মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থাকে দুখান দিয়ে বর্ণনা করেছে । আর দুখান মানে হচ্ছে ধোঁয়া ।


তারপর তিনি আকাশের দিকে মন দিলেন, আর তা ছিল ধোঁয়ার মতো । তারপর তিনি তাকে (আকাশকে) ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা কি দুজনে স্বেচ্ছায় আসবে, নাকি অনিচ্ছায় ? তারা বলল, আমরা স্বেচ্ছায় এলাম ।

“Moreover, He Comprehended in His design the sky, and id had been (as) smoke: He said to it and to the earth: ‘Come ye unwillingly’. They said: ‘We do come (together), in willing obedience’.”

কুর্‌আন ৪১;১১


এবং এই ব্যপারটি বিগ ব্যাংগ এর অবস্থানকে সমর্থন করে । এবং নিশ্চিতভাবে মুহাম্মাদ(স) এর যুগে বিগ ব্যাংগ এর ব্যাপারে কেউ জানত না । তাহলে, এই জ্ঞানের উত্‌স কি হতে পারে ?


পৃথিবীর আকৃতি গোলকীয়

আগেকার দিনের লোকেরা ভাবত যে পৃথিবী সমতল । শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ খুব দূরে যেত না এই ভয়ে যে, যদি তারা এই সমতল ভূমির শেষ প্রান্ত দিয়ে নিচে পড়ে যায় । স্যার ফ্রান্সিস ড্রাক ১৫৯৭ সালে সমুদ্রভ্রমণকালে প্রথম প্রমাণ করেন যে, পৃথিবী গোলাকৃতির ।


দিন রাত্রির পরিবর্তনের বিষয়ে কুরানের নিচের আয়াতটি বিবেচনা করে দেখা যাক ।


তুমি কি দেখ না, আল্লাহ্‌ রাত্রিকে দিনে ও দিনকে রাত্রিকে পরিবর্তন করেন ?

Seest thou not that Allah merges Night into Day and he merges Day into Night ?

[কুর্‌আন, ৩১;২৯]


এই অংশটুকুর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্‌ রাত ধীরে এবং ক্রমান্বয়ে দিনে এবং দিন ক্রমান্বয়ে রাতে পরিবর্তন হয় । এই ব্যাপারটি কেবল তখনই ঘটতে পারে যখন পৃথিবী গোলাকৃতির হয় । যদি পৃথিবী সমতল হত, তাহলে দিন-রাতের পরিবর্তন হঠাৎ করে হত ।


নিচের আয়াতটিও পৃথিবীর গোলাকৃতির বিষয়ে পরোক্ষভাবে নির্দেশ করে ।


তিনি সুপরিকল্পিতভাবে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন । তিনি রাত্রি দিয়ে দিনকে ও দিন দিয়ে রাত্রিকে ঢেকে রাখেন ।

He created the heavens and the earth in true (proportions): He makes the Night overlap the Day, and the Day overlap the Night.

কুর্‌আন ৩৯;৫


এইখানে যেই আরবী শব্দ কাওওয়ারা ব্যবহার করা হয়েছে তার অর্থ ইংরেজীতে বলা হলে তা হবে “to overlap” or “to coil” । জিনিসটা ঠিক ঐরকম, যেভাবে পাগড়ী মাথার চারপাশে ঘুরিয়ে বাধা হয় । overlapping or coiling তখনই ঘটতে পারে যদি পৃথিবীটা গোলাকৃতির হয় ।


পৃথিবী পুরোপুরি বলের গোলাকার না, মেরুর দিকে কিছুটা চাপা । নিচের আয়াতটি পৃথিবীর সত্যিকারের আকৃতি সম্পর্কে বলে ।


“And the earth, moreover, hath He made egg shaped.”


এইখানে যে আরবী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তা হল দাহাআহাআ যার অর্থ ostrich egg। এবং ostrich egg ঠিক পৃথিবীর আকৃতির মত ।


চাঁদের আলো প্রতিফলিত আলো

আগে বিশ্বাস করা হত যে, চাঁদের আলো হচ্ছে নিজস্ব আলো । কিন্তু বিজ্ঞান আজ আমাদের বলে যে, চাঁদের আলো হচ্ছে প্রতিফলিত আলো । ঠিক এই বিষয়টিই কুর্‌আনে ১৪০০ বছর আগে উল্লেখ করা হয়েছে ।


কত মহান তিনি যিনি আকাশে বুরুজ(রাশিচক্র) সৃষ্টি করেছেন এবং সেখানে স্থাপন করেছেন এক প্রদীপ্ত সূর্য ও জ্যোতির্ময় চন্দ্র ।

Blessed is He made Constellationsin the skies, and placed therein a Lamp and a Moon giving light.

কুর্‌আন ২৫;৬১


সূর্যের জন্যে কুরআনে যে আরবী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তা হল শাম্‌শ । এটা সিরাজ শব্দকেও রেফার করে যার অর্থ টর্চশাম্‌শ ওয়াহ্‌হাআজকেও নির্দেশ করে যার মানে হচ্ছে “blazing lamp”। অথবা এটা দিয়া শব্দকেও রেফার করে যার অর্থ “shining glory” এই তিনটিই শব্দই সূর্যের বর্ণনায় পুরোপুরি ঠিক যেহেতু এদের প্রতিটিই অভ্যন্তরীন দহনের ফলে আলোর সৃষ্টি করে থাকে । চাঁদের জন্যে যে আরবী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা হল কামার এবং এই কামার-কে কুর্‌আনে মুনীর দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে । আর মুনীর হচ্ছে সেই জিনিস যা আলো প্রতিফিলিত করে । কুর্‌আনের এই বর্ণনা চাঁদের সত্যিকারের প্রকৃতির সাথে মিলে যায়, কারণ চাঁদের যে আলো তা সূর্য থেকে পাওয়া আলো । কুর্‌আনের কোথাও চাঁদকে সিরাজ, ওয়াহ্‌হাআজ কিংবা দিয়া হিসেবে বর্ননা করা হয়নি । একইভাবে সূর্যকেও কখনোই নূর কিংবা মুনীর হিসেবে বর্ণনা করা হয়নি । কুর্‌আন এভাবে সুর্য ও চাঁদের আলোর মাঝে পার্থক্য করেছে ।


নিচের আয়াতটি সূর্য ও চাঁদের আলোর প্রকৃতি নির্দেশ করে ।


তিনি সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন

It is He who made the sun to be a shining glory and the moon to be a light (of beauty).

কুর্‌আন ১০,৫


তোমরা কি লক্ষ করনি আল্লাহ্‌ কিভাবে সাত স্তরে সাজানো আকাশ সৃষ্টি করেছেন, আর সেখানে চন্দ্রকে আলো হিসেবে ও সূর্যকে প্রদীপ হিসেবে স্থাপন করেছেন ?

See ye not how Allah has created the seven heavens one above another, And made the moon a light in their midst, and made the sun as a (Glorious) Lamp ?

কুর্‌আন ৭১,১৫-১৬


কুর্‌আন এবং আধুনিক বিজ্ঞান চাঁদের আলোর পার্থক্যের ক্ষেত্রে একই সুরে কথা বলে ।


সুর্যের ঘূর্ণন

দীর্ঘ দিন ধরে ইউরোপিয়ান দার্শনিক ও বিজ্ঞানিরা বিশ্বাস করতেন যে, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং সুর্যসহ অন্যান্য নক্ষত্র পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে । পশ্চিমা বিশ্বে টোলেমির সময় (খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী) থেকে পৃথিবীকেন্দ্রিক ধারণা চলে আসছিল । ১৫১২ সালে নিকোলাস কপারনিকাস তার সুর্যকেন্দ্রিক ধারণার প্রবর্তন করেন যেখানে সুর্য স্থির এবং গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে ঘোরার কথা বলা আছে ।


১৬০৯ সালে জার্মান বিজ্ঞানী জোহান কেপলার “Astronomia Nova” প্রকাশ করেন । শুধু যে গ্রহ সূর্যের চারপাশে উপবৃত্তাকার পথে ঘোরে তাই নয়, এরা নিজেদের কক্ষের চারপাশেও অনিয়মিত বেগে ঘোরে । এই জ্ঞান থেকে দিন ও রাত্রির পরিবর্তনসহ সৌরজগতের অনেক মেকানিজম ইউরোপিয়ান বিজ্ঞানীদের জন্য সম্ভব হয়ে উঠে ।


এই আবিস্কারের পর এটা ভাবা হত যে, সুর্য স্থির এবং তা পৃথিবীর মত নিজ অক্ষের চারদিকে ঘোরে না । আমি (জাকির নায়েক) নিজেও আমার স্কুল জীবনে এই জিনিস ভূগোল বইয়ে পড়েছি । নিচের আয়াতটি দেখুন


আল্লাহ্‌ই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে । প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরণ করে ।

It is He who created the Night and the Day, and the sun and the moon: All (the celestial bodies) swim along, each its rounded course.

কুর্‌আন ২১;৩৩


উপরের আয়াতটিতে ইয়াসবাহুউন নামক আরবী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে । এই শব্দটি কোন গতিশীল বস্তুর বেগের সাথে সম্পর্কিত । যদি এই শব্দটি মাটির উপরে থাকা কোন মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তাহলে এটা বুঝাবে না যে লোকটি ঘুরছে, বরঞ্চ বুঝাবে যে লোকটি হাঁটছে বা দৌঁড়াচ্ছে । আবার যদি পানিতে থাকা কোন লোকের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তাহলে এতা বুঝাবে না যে লোকটি ভেসে আছে, বরঞ্চ বুঝাবে যে, লোকটি সাঁতার কাটছে ।


একইভাবে যদি ইয়াসবাহ্‌ শব্দটি যদি সূর্যের মত কোন মহাবৈশ্বিক কোন বস্তুর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় তাহলে এ বুঝাবে না যে সেটা শূণ্যের মাঝ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, বরঞ্চ বুঝাবে যে সেটা ঘুরতে ঘুরতে শূণ্যের মাঝে স্থানান্তরিত হচ্ছে । সুর্য যে নিজ অক্ষের চারপাশে ঘুরে তা এখনকার প্রায় সব স্কুলের বইয়ে লেখা থাকে । সূর্যের নিজ অক্ষের চারপাশে ঘুরার ব্যাপারটি কোন টেবিলের উপর সূর্যের প্রতিবিম্ব দিয়ে প্রমাণ করা যায় । সুর্যের কিছু স্পট আছে যা ২৫ দিনে একবার ঘূর্ণন শেষ করে । অর্থৎ, সুর্য নিজ অক্ষের চারপাশে ২৫ দিনে একবার ঘুরে ।


সূর্য মাহশূণ্যের মধ্য দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ২৪০ কিমি বেগে ধেবে চলছে এবং এর মিলকি ওয়ে গ্যালাক্সীর কেন্দ্রের চারপাশ একবার প্রদক্ষিণ করতে ২০০ মিলিয়ন বছর সময় নেয় ।


সূর্য চন্দ্রের নাগাল পায় না, রাত্রি দিনকে অতিক্রম করে না ও প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে সাঁতার কাটে ।

It is not permitted to the Sun to catch up the Moon, nor can the Night outstrip the Day: Each(just) swims along in (its own) orbit (according to law).

কুর্‌আন ৩৬;৪০


এই আয়াতটি একটি গুরুত্বপুর্ণ সত্যকে নির্দেশ করে যা আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার মাধ্যমে সাম্প্রতিক কালের একটি আবিষ্কার ।


যেই কক্ষপথে সূর্য ঘোরে তা আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যায় ইতিমধ্যে বের করা হয়েছে । একে বলা হয় সোলার এপেক্স (Solar Apex) । পুরো সৌরজগৎটি যে বিন্দুর চারপাশে ঘুরছে তা ইতিমধ্যে পরিমাপ করে বের করা হয়েছে ।


চাঁদও পৃথিবীর চারপাশে প্রায় সারে ২৯ দিনে একবার প্রদক্ষিণ করে ।


কুর্‌আনের বৈজ্ঞানিক যথার্থতার কেউ আশ্চর্য না হয়ে পারে না । আমাদের মনে কি প্রশ্ন আসে না যে, কুর্‌আনের এই জ্ঞানের উৎস কোথায় ?


সূর্যের ধ্বংস

পাঁচ বিলিয়ন বছর ধরে সুর্যের পৃষ্ঠে ক্রমাগত রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে আলো সৃষ্টি হচ্ছে । কোন একদিন এই বিক্রিয়া শেষ হবে এবং সেইদিন সুর্যও ধ্বংস হয়ে যাবে । এর ফলে পৃথিবীর সকল জীবের পরিসমাপ্তি ঘটবে । সূর্যের ধ্বংস সম্বন্ধে কুর্‌আন বলে,


আর সূর্য নির্দিষ্ট গন্ডির মাঝে আবর্তন করে । এ শক্তিমান, সর্বজ্ঞ কর্তৃক সুনির্দিষ্ট ।

And the Sun runs its course for a period determined for it; that is the decree of (Him) the exalted in Might, the All-Knowing.

কুর্‌আন ৩৬;৩৮


মুস্তাক্বার্‌ নামে যেই আরবী শব্দটি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে, তা নির্দিষ্ট কোন স্থান বা সময়কে বুঝায় । এভাবে কুর্‌আন নির্দেশ করে সূর্য কোন নির্দিষ্ট স্থান ও নির্দিষ্ট সময়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে; যার অর্থ একদিন সুর্য ধ্বংস হবে ।


আন্তঃমহাকর্ষীয় বস্তু

জ্যোতির্বিদ্যায় আগে মনে করা হত মহাবিশ্বের নক্ষত্ররাজির মধ্যে পুরোটাই শূণ্য । কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখন জানেন যে নক্ষত্ররাজির মাঝে পদার্থ আছে যার নাম দেয়া হয়েছে প্লাজমা । প্লাজমা হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে আয়নিত গ্যাস যা সম্পরিমাণ মুক্ত ইলেক্ট্রন ও প্রোটন বহন করে । প্লাজমাকে কখনো কখনো পদার্থের চতুর্থ অবস্থাও বলা হয়ে থাকে । কুর্‌আন আন্তঃমহাকর্ষীয় বস্তু সম্পর্কে বলে,


তিনি আকাশ, পৃথিবী এবং দুয়ের মধ্যবর্তী সমস্তকিছু ছয়দিনে সৃষ্টি করেন,

He Who created the heavens and the earth and all that is between.

কুর্‌আন ২৫;৫৯


এটা হাস্যকর হবে যদি কেউ বলে যে আন্তঃমহাকর্ষীয় পদার্থের কথা ১৪০০ বছর আগে মানুষের জানা ছিল ।


ক্রমবর্ধমান মহাবিশ্ব

১৯২৫ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিদ প্রমাণ করেন যে, নক্ষত্ররাজি একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, যা নির্দেশ করে মহাবিশ্ব ক্রমবর্ধমান । মহাবিশ্ব যে ক্রমবর্ধমান তা এখন একটা বৈজ্ঞানিক সত্য । মহাবিশ্বের এই আচরণ সম্পর্কে কুর্‌আন বলে,


With power and skill did We construct the Firmament: For it is Who create the vastness of Space.

কুর্‌আন ৫১;৪৭


এখানে আরবী শব্দ মুসিনুউন ব্যবহার করা হয়েছে যা সঠিকভাবে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় “expanding it” । এবং এটা মহাবিশ্বের ক্রমবর্ধমান বিশালতাকেই নির্দেশ করে ।


বিখ্যাত astrophysicist স্টীফেন হকিং তার “A Brief History of Time” এ বলেছেন, “The discovery that the universe is expanding was one of the great intellectual revolutions of the 20th century” । মানুষ টেলিস্কোপ তৈরীরও আগে কুর্‌আন মহাবিশ্বের ক্রমবর্ধমানতা সম্পর্কে বলেছে !


কেউ কেউ বলে থাকেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের এই সত্যগুলো আশ্চর্য হওয়ার মত কিছু না, কারণ আরবরা তখন জ্যোতির্বিদ্যায় অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছিল । এটা ঠিক যে আরবরা জ্যোতির্বিদ্যায় বেশ অগ্রগতি অর্জন করেছিল । কিন্তু তারা এ ভুলে যায় যে, তারা যখন জ্যোতির্বিদ্যায় অগ্রগতি লাভ করেছিল তার অনেক আগেই কুর্‌আন নাজিল হয়েছিল । তার উপর বিগ ব্যাংগ এর মত কিছু ঘটনা যা কুর্‌আন নির্দেশ করেছে, তা আরবদের সর্বোচ্চ বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির সময়েও আবিস্কৃত হয় নি । তাই এই বৈজ্ঞানিক সত্য ঘটনাগুলো যা কুর্‌আনের নির্দেশ করা হয়েছে, তা আরবদের জ্যোতির্বিদ্যায় অগ্রগতির ফসল ছিল না । সত্যি কথা বলতে, বরঞ্চ উল্টটাই সত্যি যে, আরবরা জ্যোতির্বিদ্যায় অগ্রগতি লাভ করেছিল, কারণ জ্যোতির্বিদ্যা কুর্‌আনের একটা অংশ দখল করে আছে ।

Sunday, July 20, 2008

বউ পেটানো

মাসুদ রানা

১৯ জুলাই, ২০০৮, সুকুবা, জাপান

বউ পেটানো

গত বছর দেশ থেকে ফেরার পর আমি ইসলাম সম্পর্কে প্রচুর লেকচার শুনেছি, কিছু পড়াশোনা করেছি, অনেক আলোচনা করেছি, এবং প্রচুর চিন্তা করেছি । ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে মনে হত ইসলাম একটা চমৎকার জিনিস । কিন্তু আমাদের দেশের মুসলমান, এবং অন্যান্য দেশের মুসলমানদের দেখে তা মনে হত না এবং এখনও তা মনে হয় না ।


প্রথম কথা হচ্ছে আমরা ইসলামের মত এত চমৎকার একটা জিনিস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি না, আর যারা আমাদের দেশের তথাকথিত ধার্মিক বলে পরিচিত তারাও কোন না কোন ভাবে ব্রেন ওয়াশ্‌ড হয়ে যায় ।


যাই হোক, আজকে আমি ঐ সম্পর্কে বলবো না । আজকে স্বামী-স্ত্রী নিয়ে কিছু বলবো । ইসলাম মানুষকে চিন্তা করতে বলেছে । কোরানে যে কতবার কত ভাবে মানুষকে চিন্তা করতে বলা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই । কোরানে জ্ঞান সম্পর্কে বলা আছে ৮৫৪ বার । আর এই জ্ঞান অর্জন করা বা চিন্তা করা কিছু তথাকথিত আলেমদের কাজ না, আমাদের সবার কাজ; এবং আলেমরা সবসময় যে ব্যাখ্যা দেয় তাও সবসময় ঠিক হওয়ার কথা না, কারণ তারা ভূল করতেই পারে ।


আমাদের দেশের তথাকথিত ধার্মিকরা সবসময় বলে থাকে, পুরুষ হচ্ছে ঘরের গার্ডিয়ান । হায় অজ্ঞ, কোথায় পেয়েছে তারা এই কথা ? কোরানে ? আমি বলছি কোথায় পেয়েছে সূরা নিসার আয়াত নম্বর ৩৪ এ । এই আয়াতের একদম প্রথম অংশ হচ্ছে, পুরুষ নারীর রক্ষাকারী এবং ভরণপোষণকারী, কারণ আল্লাহ্‌ এককে অপরের উপর বিশিষ্টতা দান করেছেন । শুধু এই অংশটুকু নিয়েই আমার অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু আজ থাক । এই আয়াতের এই অংশটুকু অনেকে ভূল অনুবাদ করে থাকে এইভাবে যে, পুরুষ নারীর রক্ষাকর্তা, কারণ আল্লাহ্‌ এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন । আর এই ভূল অনুবাদ পড়ে আমাদের পুরুষেরা বিশেষ করে মোল্লারা মনে করে যে, তারা তাদের স্ত্রীদের চেয়ে সেরা এবং, স্ত্রীদের একমাত্র কাজ হচ্ছে, স্বামীর সেবা করা । হ্যাঁ, আমি জানি, কোরানে বলা আছে, স্ত্রীদের স্বামীর প্রতি অনুগত থাকতে, কিন্তু আমাদের দেশের লোকেরা বা মোল্লারা যেই অনুগত বোঝায়, এই অনুগত সেই অনুগত না, সত্যি বলছি অনুগত থাকার প্যাটার্ন ঐরকম না ।


এবং সূরা নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতে এও আছে, যদি স্ত্রীরা অবাধ্য হয় তাহলে তাদেরকে প্রহার কর । যদিও প্রহার করার আগে ২ টা শর্ত আছে । স্ত্রীর সাথে করতে বলা হয়েছে সদয় ব্যবহার । বেশ কয়েকবার বলা আছে । এমনকি কোরানে এও বলা আছে, যদি কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে পছন্দ নাও করে তাও যেন সে সদয় ব্যবহার করে । একজন পুরুষ যখন তার স্ত্রীকে মারে, কিংবা তারই ছেলে-মেয়েদের সামনে মারতে যায়, আমার প্রশ্ন ঐ লোকের কাছে, সে কি আসলেও মুসলমান ? সে তো আল্লাহ্‌র আদেশ সরাসরি অমান্য করছে । শুধু দিনে পাঁচবার নামাযের নামে উঠাবসা করব, কিন্তু মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করব, মানুষকে গালি দিব; আর জান্নাতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখব ! হায় ! কি মূর্খতা । সূরা নিসায় কখনোই বউকে পেটানোর কথা বলা হয় নি । ঐ আয়াতে আরবী ওয়াদরিবু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার মূল শব্দ হচ্ছে দারাবা । দারাবা এর অর্থ বাংলায় একটা মাত্র শব্দে করাটা কঠিন, আসলে সম্ভবই না । তাই আমাদের অনুবাদকেরা ঐটাকে প্রহার করা হিসেবে অনুবাদ করেছে । ইংরেজিতে বললে কিছুটা কাছাকাছি বলা যায়, step forth, tap। তাও অনেক বুঝানোর পরে , তারপর একই বিছানায় না ঘুমিয়ে, তারপর সেইটা । হাদীস কুর্‌আনকে বুঝতে সাহায্য করে । বুখারী, মুসলিম এর হাদীস,

"Could any of you beat your wife as he would a slave, and then lie with her in the evening?"
এই বৌ পেটানো সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ্‌ আবু দাউদ এ বলেছেন,

"Never beat God's handmaidens."

আর রাসুলুল্লাহ্‌(স) যেখানে বলেছেন, তোমাদের মাঝে সেই সেরা মুমিন যে তার স্ত্রীর কাছে সেরা । স্ত্রীর সাথে চরম খারাপ ব্যবহার করে কিভাবে একজন মানুষ মুমিন হওয়ার স্বপ্ন দেখে ? স্ত্রী অবাধ্য হলে আমরা তাকে বুঝাতে পারি, কিন্তু কখনোই খারাপ ব্যবহার করতে পারি না । স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করে আল্লাহ্‌র সামনে গিয়ে দাঁড়াতে লজ্জা করে না ?


কিছুদিন আগে আমার এক বান্ধবী ৫০টা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্নহত্যা করার চেষ্টা করেছিল । আল্লাহ্‌ তাকে রক্ষা করেছেন, আল্লাহ্‌কে ধন্যবাদ । আমি তার সাথে কথা বলেছি, এই ঘটনার পরে । তার একটা দুঃখ হচ্ছে, তার মা বাবার সাথে মিল নেই । এমন না যে, এরকম ঘটনা ঘটে না, প্রায়ই ঘটে । কিন্তু আমার দেখা এই ছিল প্রথম, এবং ঘটনাটা মাত্র কয়েকদিন আগে ঘটেছে । বাবা মার এই ঝগড়া, মায়ের উপর বাবার অত্যাচার যে ছেলেমেয়েদের উপর কেমন প্রভাব ফেলে, একমাত্র যাদের ক্ষেত্রে ঘটেছে, তারাই বলতে পারবে !! আল্লাহ্‌ এদের কিভাবে মাফ করবেন ? যারা নিজেদের স্ত্রীদের উপর শারীরিক কিংবা মানষিক, কিংবা দুইভাবেই অত্যাচার করে, তারা কিভাবে আল্লাহ্‌র ঘনিষ্ঠতা অর্জন করবে ? তারা কিভাবে জান্নাতে যাবে ?


হয়তো বউ পেটানোর ট্রেডিশনটা এখন আর তেমন নেই, কিন্তু স্ত্রীরা শুধু স্বামীর সেবা করবে এই ধারণাটা এখনও আছে । সেবার ধরণটা কি সেটা যদি মোল্লাদের জিজ্ঞেস করা হয়, আমার মনে হয় পরিস্কার করে বলতে পারবে না ।


নামায এত চমৎকার একটা জিনিস ! একজন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পরে এমন মানুষ কিভাবে মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারে ? সে কি আসলেও নামায পরে, নাকি নামায কি তাই ই জানে নাশুধু উঠা-বসা করে ? নামাযে যে শান্তি পাওয়া যায়, ঐ শান্তি নিয়ে কিভাবে একজন মানুষ অন্য মানুষের সাথে কিভাবে খারাপ ব্যবহার করে, কিভাবে অন্যকে খারাপ নামে ডাকে, কিভাবে অন্যকে গালি দেয়, কিভাবে নিজের আত্নীয়-স্বজনের সাথে রূঢ় ব্যবহার করে ? এরা কি আল্লাহ্‌র সান্যিধ্য পাবে ?


আমাদের দেশের হুজুর-মোল্লাদের তাদের ছেলেমেয়েরা দেখলে ভয় পায় । কেন ? তাদের মুখে হাসি থাকে না । ছেলেমেয়েদের সাথে সময় দেয় না । ভালভাবে কথাও বলে না । এদেরকে ছেলেমেয়েরা কিভাবে মান্য করবে ? রাসুলুল্লাহ্‌(স) যখন তার মেয়ে ফাতিমার কাছে যেতেন, তখন কপালে চুমু খেতেন । তারপর তাকে আস্তে করে নিজের পাশে বসিয়ে গল্প করতেন । রাসুলুল্লাহ্‌(স) যখন বাসা থেকে বের হতেন, তখন তার স্ত্রী আয়েশার হাতে চুমু খেতেন । কি শিখেছি আমরা এইখান থেকে ? যারা মুখে বলে রাসুলুল্লাহ্‌(স) আমাদের আদর্শ, যতদিন না পর্যন্ত তারা নামায-রোযার বাইরে এইসবও করতে পারবে, কিভাবে বলবো তারা রাসুলুল্লাহ্‌(স) এর আদর্শকে মেনে চললো ? অজ্ঞরা তর্কের খাতিরে বলবে, ছেলেমেয়েরা ভাল না, বউ ভাল না । হায়রে, ছেলেমেয়েরা তো বাবার পরে জন্ম নিয়েছে, বউ তো নতুন অবস্থায় স্বামীর ঘরে এসেছে, যদি স্বামী নিজে ভাল হত, তাহলে ছেলেমেয়েও ভাল হত, বেয়াদব হত না । ছেলেমেয়ে বেয়াদব যদি হয়েই থাকে, তাহলে তা ঐ লোকটার কারণেই হয়েছে । আর সত্যি কথা, একজন মুসলমান, কিভাবে তার বউ, ছেলেমেয়ে, আত্নীয়-স্বজনদের নিন্দা করতে পারে ? গালি দিতে পারে ? রাসুলুল্লাহ্‌(স) কি এগুলো করতেন ? আমরা শুধু নবীর মসজিদের ভিতরের অংশটুকুই পালন করি, মসজিদের বাইরে করি না । আল্লাহ্‌ মানুষকে দুনিয়াতে তার প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছেন । মানুষের কাজ কি এক কথায় বলতে গেলে, দুনিয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা । আর যে লোক, সে যতোই নামায-রোযা করুক না কেন, যদি নিজের ঘরে শান্তি রাখতে না পারে ধিক তারে, সে যেন নিজেকে মুসলমান না বলে !


ডা, লুৎফর রহমানের উচ্চ জীবন এর একটা উদ্বৃতি দিয়ে শেষ করি ।


পত্নীকে ভাল হবার উপদেশ দিলে চলবে না । পুরুষেরা যদি নিজেদের স্বভাব ও ব্যবহারগুলিকে সুন্দর না করেন তাহলে শুধু নারীকে ভাল হবার জন্যে যতই বলা হোক না কেন, কোন কাজ হবে না । যত আঘাত করবে মানব-আত্না ততই বিদ্রোহী হবে । হীন নরপিশাচের স্পর্শে এলে অতি ভাল লোকও জঘন্য প্রকৃতির হয়ে ওঠেন । স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে যদি প্রেম ও শ্রদ্ধা করেন, তাহলে মানুষের জীবন কত সুখময় হয় ।


আল্লাহ্‌ আমাকে এই বেড়াকল থেকে বাইরে থাকতে সাহায্য করবেন এই আমার আশা । আমার যেকোন ভুলের জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ।


বিদ্র,

বউ পেটানো সম্পর্কে ইউসুফ এস্‌টেস এর একটা ভাল আর্টিকেল আছে । ইচ্ছা করলে দেখতে পারেন ।


http://www.islamnewsroom.com/content/view/352/52/