Sunday, July 20, 2008

বউ পেটানো

মাসুদ রানা

১৯ জুলাই, ২০০৮, সুকুবা, জাপান

বউ পেটানো

গত বছর দেশ থেকে ফেরার পর আমি ইসলাম সম্পর্কে প্রচুর লেকচার শুনেছি, কিছু পড়াশোনা করেছি, অনেক আলোচনা করেছি, এবং প্রচুর চিন্তা করেছি । ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে মনে হত ইসলাম একটা চমৎকার জিনিস । কিন্তু আমাদের দেশের মুসলমান, এবং অন্যান্য দেশের মুসলমানদের দেখে তা মনে হত না এবং এখনও তা মনে হয় না ।


প্রথম কথা হচ্ছে আমরা ইসলামের মত এত চমৎকার একটা জিনিস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি না, আর যারা আমাদের দেশের তথাকথিত ধার্মিক বলে পরিচিত তারাও কোন না কোন ভাবে ব্রেন ওয়াশ্‌ড হয়ে যায় ।


যাই হোক, আজকে আমি ঐ সম্পর্কে বলবো না । আজকে স্বামী-স্ত্রী নিয়ে কিছু বলবো । ইসলাম মানুষকে চিন্তা করতে বলেছে । কোরানে যে কতবার কত ভাবে মানুষকে চিন্তা করতে বলা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই । কোরানে জ্ঞান সম্পর্কে বলা আছে ৮৫৪ বার । আর এই জ্ঞান অর্জন করা বা চিন্তা করা কিছু তথাকথিত আলেমদের কাজ না, আমাদের সবার কাজ; এবং আলেমরা সবসময় যে ব্যাখ্যা দেয় তাও সবসময় ঠিক হওয়ার কথা না, কারণ তারা ভূল করতেই পারে ।


আমাদের দেশের তথাকথিত ধার্মিকরা সবসময় বলে থাকে, পুরুষ হচ্ছে ঘরের গার্ডিয়ান । হায় অজ্ঞ, কোথায় পেয়েছে তারা এই কথা ? কোরানে ? আমি বলছি কোথায় পেয়েছে সূরা নিসার আয়াত নম্বর ৩৪ এ । এই আয়াতের একদম প্রথম অংশ হচ্ছে, পুরুষ নারীর রক্ষাকারী এবং ভরণপোষণকারী, কারণ আল্লাহ্‌ এককে অপরের উপর বিশিষ্টতা দান করেছেন । শুধু এই অংশটুকু নিয়েই আমার অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু আজ থাক । এই আয়াতের এই অংশটুকু অনেকে ভূল অনুবাদ করে থাকে এইভাবে যে, পুরুষ নারীর রক্ষাকর্তা, কারণ আল্লাহ্‌ এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন । আর এই ভূল অনুবাদ পড়ে আমাদের পুরুষেরা বিশেষ করে মোল্লারা মনে করে যে, তারা তাদের স্ত্রীদের চেয়ে সেরা এবং, স্ত্রীদের একমাত্র কাজ হচ্ছে, স্বামীর সেবা করা । হ্যাঁ, আমি জানি, কোরানে বলা আছে, স্ত্রীদের স্বামীর প্রতি অনুগত থাকতে, কিন্তু আমাদের দেশের লোকেরা বা মোল্লারা যেই অনুগত বোঝায়, এই অনুগত সেই অনুগত না, সত্যি বলছি অনুগত থাকার প্যাটার্ন ঐরকম না ।


এবং সূরা নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতে এও আছে, যদি স্ত্রীরা অবাধ্য হয় তাহলে তাদেরকে প্রহার কর । যদিও প্রহার করার আগে ২ টা শর্ত আছে । স্ত্রীর সাথে করতে বলা হয়েছে সদয় ব্যবহার । বেশ কয়েকবার বলা আছে । এমনকি কোরানে এও বলা আছে, যদি কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে পছন্দ নাও করে তাও যেন সে সদয় ব্যবহার করে । একজন পুরুষ যখন তার স্ত্রীকে মারে, কিংবা তারই ছেলে-মেয়েদের সামনে মারতে যায়, আমার প্রশ্ন ঐ লোকের কাছে, সে কি আসলেও মুসলমান ? সে তো আল্লাহ্‌র আদেশ সরাসরি অমান্য করছে । শুধু দিনে পাঁচবার নামাযের নামে উঠাবসা করব, কিন্তু মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করব, মানুষকে গালি দিব; আর জান্নাতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখব ! হায় ! কি মূর্খতা । সূরা নিসায় কখনোই বউকে পেটানোর কথা বলা হয় নি । ঐ আয়াতে আরবী ওয়াদরিবু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার মূল শব্দ হচ্ছে দারাবা । দারাবা এর অর্থ বাংলায় একটা মাত্র শব্দে করাটা কঠিন, আসলে সম্ভবই না । তাই আমাদের অনুবাদকেরা ঐটাকে প্রহার করা হিসেবে অনুবাদ করেছে । ইংরেজিতে বললে কিছুটা কাছাকাছি বলা যায়, step forth, tap। তাও অনেক বুঝানোর পরে , তারপর একই বিছানায় না ঘুমিয়ে, তারপর সেইটা । হাদীস কুর্‌আনকে বুঝতে সাহায্য করে । বুখারী, মুসলিম এর হাদীস,

"Could any of you beat your wife as he would a slave, and then lie with her in the evening?"
এই বৌ পেটানো সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ্‌ আবু দাউদ এ বলেছেন,

"Never beat God's handmaidens."

আর রাসুলুল্লাহ্‌(স) যেখানে বলেছেন, তোমাদের মাঝে সেই সেরা মুমিন যে তার স্ত্রীর কাছে সেরা । স্ত্রীর সাথে চরম খারাপ ব্যবহার করে কিভাবে একজন মানুষ মুমিন হওয়ার স্বপ্ন দেখে ? স্ত্রী অবাধ্য হলে আমরা তাকে বুঝাতে পারি, কিন্তু কখনোই খারাপ ব্যবহার করতে পারি না । স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করে আল্লাহ্‌র সামনে গিয়ে দাঁড়াতে লজ্জা করে না ?


কিছুদিন আগে আমার এক বান্ধবী ৫০টা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্নহত্যা করার চেষ্টা করেছিল । আল্লাহ্‌ তাকে রক্ষা করেছেন, আল্লাহ্‌কে ধন্যবাদ । আমি তার সাথে কথা বলেছি, এই ঘটনার পরে । তার একটা দুঃখ হচ্ছে, তার মা বাবার সাথে মিল নেই । এমন না যে, এরকম ঘটনা ঘটে না, প্রায়ই ঘটে । কিন্তু আমার দেখা এই ছিল প্রথম, এবং ঘটনাটা মাত্র কয়েকদিন আগে ঘটেছে । বাবা মার এই ঝগড়া, মায়ের উপর বাবার অত্যাচার যে ছেলেমেয়েদের উপর কেমন প্রভাব ফেলে, একমাত্র যাদের ক্ষেত্রে ঘটেছে, তারাই বলতে পারবে !! আল্লাহ্‌ এদের কিভাবে মাফ করবেন ? যারা নিজেদের স্ত্রীদের উপর শারীরিক কিংবা মানষিক, কিংবা দুইভাবেই অত্যাচার করে, তারা কিভাবে আল্লাহ্‌র ঘনিষ্ঠতা অর্জন করবে ? তারা কিভাবে জান্নাতে যাবে ?


হয়তো বউ পেটানোর ট্রেডিশনটা এখন আর তেমন নেই, কিন্তু স্ত্রীরা শুধু স্বামীর সেবা করবে এই ধারণাটা এখনও আছে । সেবার ধরণটা কি সেটা যদি মোল্লাদের জিজ্ঞেস করা হয়, আমার মনে হয় পরিস্কার করে বলতে পারবে না ।


নামায এত চমৎকার একটা জিনিস ! একজন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পরে এমন মানুষ কিভাবে মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারে ? সে কি আসলেও নামায পরে, নাকি নামায কি তাই ই জানে নাশুধু উঠা-বসা করে ? নামাযে যে শান্তি পাওয়া যায়, ঐ শান্তি নিয়ে কিভাবে একজন মানুষ অন্য মানুষের সাথে কিভাবে খারাপ ব্যবহার করে, কিভাবে অন্যকে খারাপ নামে ডাকে, কিভাবে অন্যকে গালি দেয়, কিভাবে নিজের আত্নীয়-স্বজনের সাথে রূঢ় ব্যবহার করে ? এরা কি আল্লাহ্‌র সান্যিধ্য পাবে ?


আমাদের দেশের হুজুর-মোল্লাদের তাদের ছেলেমেয়েরা দেখলে ভয় পায় । কেন ? তাদের মুখে হাসি থাকে না । ছেলেমেয়েদের সাথে সময় দেয় না । ভালভাবে কথাও বলে না । এদেরকে ছেলেমেয়েরা কিভাবে মান্য করবে ? রাসুলুল্লাহ্‌(স) যখন তার মেয়ে ফাতিমার কাছে যেতেন, তখন কপালে চুমু খেতেন । তারপর তাকে আস্তে করে নিজের পাশে বসিয়ে গল্প করতেন । রাসুলুল্লাহ্‌(স) যখন বাসা থেকে বের হতেন, তখন তার স্ত্রী আয়েশার হাতে চুমু খেতেন । কি শিখেছি আমরা এইখান থেকে ? যারা মুখে বলে রাসুলুল্লাহ্‌(স) আমাদের আদর্শ, যতদিন না পর্যন্ত তারা নামায-রোযার বাইরে এইসবও করতে পারবে, কিভাবে বলবো তারা রাসুলুল্লাহ্‌(স) এর আদর্শকে মেনে চললো ? অজ্ঞরা তর্কের খাতিরে বলবে, ছেলেমেয়েরা ভাল না, বউ ভাল না । হায়রে, ছেলেমেয়েরা তো বাবার পরে জন্ম নিয়েছে, বউ তো নতুন অবস্থায় স্বামীর ঘরে এসেছে, যদি স্বামী নিজে ভাল হত, তাহলে ছেলেমেয়েও ভাল হত, বেয়াদব হত না । ছেলেমেয়ে বেয়াদব যদি হয়েই থাকে, তাহলে তা ঐ লোকটার কারণেই হয়েছে । আর সত্যি কথা, একজন মুসলমান, কিভাবে তার বউ, ছেলেমেয়ে, আত্নীয়-স্বজনদের নিন্দা করতে পারে ? গালি দিতে পারে ? রাসুলুল্লাহ্‌(স) কি এগুলো করতেন ? আমরা শুধু নবীর মসজিদের ভিতরের অংশটুকুই পালন করি, মসজিদের বাইরে করি না । আল্লাহ্‌ মানুষকে দুনিয়াতে তার প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছেন । মানুষের কাজ কি এক কথায় বলতে গেলে, দুনিয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা । আর যে লোক, সে যতোই নামায-রোযা করুক না কেন, যদি নিজের ঘরে শান্তি রাখতে না পারে ধিক তারে, সে যেন নিজেকে মুসলমান না বলে !


ডা, লুৎফর রহমানের উচ্চ জীবন এর একটা উদ্বৃতি দিয়ে শেষ করি ।


পত্নীকে ভাল হবার উপদেশ দিলে চলবে না । পুরুষেরা যদি নিজেদের স্বভাব ও ব্যবহারগুলিকে সুন্দর না করেন তাহলে শুধু নারীকে ভাল হবার জন্যে যতই বলা হোক না কেন, কোন কাজ হবে না । যত আঘাত করবে মানব-আত্না ততই বিদ্রোহী হবে । হীন নরপিশাচের স্পর্শে এলে অতি ভাল লোকও জঘন্য প্রকৃতির হয়ে ওঠেন । স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে যদি প্রেম ও শ্রদ্ধা করেন, তাহলে মানুষের জীবন কত সুখময় হয় ।


আল্লাহ্‌ আমাকে এই বেড়াকল থেকে বাইরে থাকতে সাহায্য করবেন এই আমার আশা । আমার যেকোন ভুলের জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ।


বিদ্র,

বউ পেটানো সম্পর্কে ইউসুফ এস্‌টেস এর একটা ভাল আর্টিকেল আছে । ইচ্ছা করলে দেখতে পারেন ।


http://www.islamnewsroom.com/content/view/352/52/

No comments:

Post a Comment